বিশ্বের প্রতিটি দেশেই একজন করে শাসনকর্তা রয়েছেন। একটি রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে সারা বিশ্বজুড়েই তারা স্বাভাবিকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু সবাই সমানভাবে পরিচিতি লাভ করেন না। নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পরই মানুষ তাদের ভুলে যান। কিন্তু সবাইকে মানুষ ভুলে যায় না। এমন অনেক দেশের শাসনকর্তা রয়েছেন যারা যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে থাকবেন। এমনই একজন হচ্ছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ।
ধরুন আপনি একটি শহরের মেয়র। তাহলে আপনি কি করবেন? নিশ্চয়ই সকাল বেলা দামী গাড়িতে করে অফিসে এসে এসি রুমে বসে সারাদিন অফিস করবেন আর দিনশেষে আবার দামী গাড়িতে করে বাসায় যাবেন। কিন্তু শুনে অবাক হতে হয় যে, মাহমুদ আহমেদিনেজাদ যখন তেহরানের মেয়র ছিলেন তখন তিনি নিজ হাতে তেহরানের রাস্তা ঝাড়ু দিতেন। আমাদের দেশে এরকমটি হলে সেটি সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম দাবীদার। আমাদের দেশে কেনো বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন নজিড় আছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।
কে এই আহমেদিনেজাদ?
আহমেদিনেজাদ এর বাবা ছিলেন একজন সামান্য কামার। এটা তেমন কোনো আশ্চর্যজনক তথ্য নয়। বিশ্বে এরকম আরও অনেক ভুরি ভুরি তথ্য রয়েছে। তবে কামারের ছেলে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তিনি নিজেকে অর্থলোভী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন নি এ রকম উদাহরণ বাইনোকুলার দিয়ে খুঁজে আরও দু একটি পাওয়া যেতে পারে। ১৯৭৯ সালে ইরানের যে হাজার হাজার ছাত্র আমেরিকান দূতাবাস আক্রমণ করে ৫৩ জন কূটনীতিক কে বন্দী করে আহমেদিনেজাদ ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। মাহমুদ আহমেদিনেজাদ পেশায় একজন পিএইচডি ধারী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়াও তিনি ছিলেন তেহরান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির অধ্যাপক, রাজধানী তেহরানের মেয়র এবং ইরান রেভলুশনারি গার্ড এর প্রধান। ইরানের ষষ্ট প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০৫ – ২০১৩ মেয়াদে তিনি নির্বাচিত হন।
জন্ম:
মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ১৯৫৬ সালের ২৮ আক্টোবর সেমনান প্রদেশের গারমশার নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। খুব গরিব পরিবারে জন্মগ্রহন করেন তিনি।তার বাবা ছিলেন পেশায় একজন কামার আর মায়ের নাম খানম। মায়ের উপাধি ছিল সাইয়েদা যা শুধু মাত্র মুহাম্মদ (সা ) এর বংশধর হলেই এই উপাধিতে ডাকা হয়।
শিক্ষা জীবন:
আহমেদিনেজাদের বয়স যখন চার বছর তখন তার বাবা জীবিকার সন্ধানে পরিবারসহ তেহরানে চলে আসেন। সেখানেই আহমেদিনেজাদের স্কুল জীবন শুরু। ১৯৭৬ সালে আহমেদিনেজাদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করেন এবং তিনি ৪০০,০০০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৩২তম স্থান দখল করেন। তিনি ইরান ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড টেকনোলোজিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হন এবং ১৯৯৭ সালে তিনি ট্রান্সপর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্লানিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
একেবারেই সাদামাটা জীবনযাপন:
প্রেসিডেন্ট হবার আগে তার জীবনযাপন যেমনটি ছিল এখনও ঠিক তেমনটিই রয়েছে। আভিজাত্য তাকে কখনও স্পর্শ করতে পারে নি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিলাসবহুল এক বাড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছিল কিন্তু সেই বাড়িকে তুচ্ছজ্ঞান করে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বস্তির সেই দুই রুমের ছোট্ট বাড়িতেই বসবাস করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিরাপত্তার কারনে সরকারের কর্মকর্তাগণের অনুরোধে তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনেই বসবাস করেন তিনি। তার নিজের বাড়িতে যে আসবাবপত্র রয়েছে তা আমাদের দেশের অনেক কেরানির বাড়িতেও এর চাইতে ভালো আসবাবপত্র রয়েছে। তার বাসায় কয়েকটি কাঠের চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাবপত্র নেই। তাহলে ঘুমায় কোথায়? ঘুমানোর জন্য রয়েছে মাটির বিছানা। প্রেসিডেন্ট ভবনেও তিনি ফ্লোরে কার্পেটের উপর ঘুমাতেন।
প্রেসিডেন্টের ছেলের বিয়েতে পোলাও-কোরমা নেই!
ভাবতে অবাক লাগে একটি দেশের প্রেসিডেন্টের ছেলের বিয়ে। সেখানে হাজার হাজার লোক আমন্ত্রিত হবে, কোরমা-পোলাও দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে। কিন্তু হাজার তো দূরের কথা দাওয়াত দিয়েছিলেন মাত্র ৪৫ জন অতিথিকে। আর পোলাও-কোরমা তো কোনো ছাড়। অতিথিদের আপ্যায়নের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। শুধুমাত্র কমলা, আপেল, কলা ও ছোট এক টুকরো কেক দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়েছিল। অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ এর চেয়ে বেশি অতিথি দাওয়াত করে ওই ফলটুকুও খাওয়ানোর সামর্থ্য তার নেই।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ ও সংসার খরচ:
তিনি ইরানের সরকার প্রধান তারপরও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে তার আছে তেহরানের বস্তিতে অবস্থিত ছোট্ট একটি বাড়ি, যা ৪০ বছর আগে তিনি তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। বাড়িটির নাম. শুনলে অবাক লাগে তার ব্যাংক একাউন্টে বেতনের জমানো কিছু টাকা ছাড়া আর কোনও সম্পদ নেই। বেতন হিসেবে তিনি তেহরান ইউনিভার্সিটি থেকে মাত্র ২৫০ ইউ এস ডলার পান। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান অথচ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র থেকে তিনি কোনও টাকা নেন না। তিনি ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাপ্ত বেতনের টাকা দিয়ে সংসার পরিচালনা করেন।
সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আহমেদিনেজাদ সকাল ৭ টায় অফিসে যান। স্ত্রীর হাতে বানানো সাদামাটা নাস্তা খেয়েই রওনা হন অফিসের দিকে। যাওয়ার সময় সাথে করে কালো ব্যাগে করে নিয়ে যান দুপুরের খাবার। দুপুরে অফিসে সবার সামনে মেঝের কার্পেটে বসে সেই খাবার খান। দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় তিনি বাসার দারোয়ান, পথচারী ও সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে কাটান এবং তাদের সাথে সুখ-দুঃখ শেয়ার করেন।
প্রতিদিন মাত্র ৩ ঘন্টা ঘুমান!
আহমেদিনেজাদের দিন শুরু হয় ভোর ৫ টায় এবং শেষ হয় রাত ২ টায়। মাঝখানের এই ৩ ঘন্টা সময় তিনি ঘুমান। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও যে মানুষটি প্রেসিডেন্ট হয়ে ছেড়া জামা পড়ে অফিসে যেতে পারেন, বস্তিতে থাকতে পারেন তার পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। প্রতিদিন সকাল ৫ টায় ফজরের নামায পড়ে কাজ শুরু করেন আর রাত ২ টায় এশার নামায ও ব্যক্তিগত স্টাডি শেষ করে ঘুমাতে যান। এই লোকটি কখনও নামায বাদ দেন না। রাস্তায় থাকাকালে নামাযের সময় হলে তিনি রাস্তায় ছোট্ট কাপড় বিছিয়ে সেখানেই নামায আদায় করে নেন। রাষ্ট্রীয় সব বড় বড় নামাযের জামাতে তিনি সব সময় পিছনের সারিতে সাধারণ মানুষের সাথে বসতে ভালবাসেন। তিনি তার নিজের জীবন নিয়েও শঙ্কিত থাকে না। সেজন্য অধিকাংশ সময় সামরিক বাহিনী ছাড়াই তিনি চলাফেরা করেন। তিনি মনে করেন মহান আল্লাহ তার সর্বোত্তম দেহরক্ষী।
আহমেদিনেজাদ রাজনীতিতে আসেন ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পরপরই। ২০০৩ সালে মেয়র নির্বাচিত হন তেহরানের। এরপর ক্রমশ এগিয়ে যান তিনি। দুই বছর তেহরানের মেয়র থাকার পর ২০০৫ সালে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আহমাদিনেজাদ ক্ষমতায় আসেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই তিনি তার অফিসে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। প্রেসিডেন্ট ভবনের দরজা-জানালা খুলে দেয়া হয় সাধারণের জন্য। প্রেসিডেন্ট অফিসে সপ্তায় পাঁচ দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সাধারণ ইরানিদের চিঠি গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই প্রেসিডেন্ট ভবনের দামি কার্পেটগুলো তেহরাণের মসজিদে দান করে দেন। এরপরিবর্তে সাধারণ মানের কার্পেট বিছানো হয় প্রেসিডেন্ট ভবনে। প্রেসিডেন্ট ভবনের ভিআইপি অতিথিশালাও বন্ধ করে দেয়া হয়। একটি সাধারণ ঘরেই ভিআইপিদের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা রাখা হয়।
প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় গ্রহণ:
৩ আগস্ট, ২০১৩ ইরানের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেয়ার আগেও ইতিহাস তৈরি করে গেলেন আহমেদিনেজাদ। ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান আয়াতুল্লাহ সাদেক লারিজানির কাছে লেখা এক চিঠিতে আট বছরে অর্জিত সম্পদের হিসাব দিয়ে যান তিনি। যে হিসাবে দেখা যায়, ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তার সম্পদে যে পরিবর্তন এসেছে, তা হলো- তিনি তার পুরোনো বাড়িটি পুনর্নিমাণ করেছেন। তবে বাড়িটি পুনর্নিমাণের জন্য তিনি ব্যাংক ও প্রেসিডেন্ট দপ্তরের ফান্ড থেকে ঋণ নেন। প্রেসিডেন্টের দপ্তরের ফান্ড ও ব্যাংক থেকে বাড়ি নির্মাণের জন্য অসংখ্য মানুষ ঋণ নিয়েছেন। প্রেসিডেন্টও সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে সেই ঋণ নিয়েছেন। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোন ধরনের প্রভাব খাটাননি। একইসঙ্গে বাড়ি পুনর্নিমাণের ক্ষেত্রে তার স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনরাও সহযোগিতা করেছেন। পুনর্নিমিত দুই তলা ভবনে চারটি ফ্লাট রয়েছে। ওই ভবনেই তিনি ও তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসবাস করবেন। যে জমিতে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটার আয়তন মাত্র ১৭৫ বর্গমিটার। জমিটুকু বাবার কাছ থেকে পাওয়া।
পরিশেষে:
বর্তমান সময়ে বিশ্বে ইরানের অবস্থান কোথায় তা আমরা সকলেই জানি। এই সাদামাটা একজন মানুষই ইরানকে এই অবস্থানে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি এখন আর ইরানের প্রেসিডেন্ট নন। তাহলে কি ইরানের জনগণ তাকে ভোট দেননি? না সেরকম নয়। সম্ভব হলে ইরানের জনগণ তাকে সারাজীবন প্রেসিডেন্ট করে রাখতো। ইরানের আইনে পরপর দুইবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তৃতীয়বার সে আর প্রার্থী হতে পারেন না। সারা বিশ্বের শাসনকর্তাদের জন্য তিনি একজন রোল মডেল। তার গুণের ৫% যদি অনুন্নত অন্য কোনো দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে থাকে তাহলে সেই দেশ উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না বলে বিশ্বাস করি।
You must be logged in to post a comment.