অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা উপাখ্যান অবলম্বনে কিছু রূপান্তরসহ দুই ভিন্ন সময়ে এবং দুটি আলাদা আঙ্গিকে ‘চিত্রাঙ্গদা’ রচনা করেছিলেন। ১৮৯২-এ তাঁর একত্রিশ বছর বয়সে রচনা করেন কাব্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ এবং এর প্রায় চুয়াল্লিশ বছর পর ১৯৩৬-এ পঁচাত্তর বছর বয়সে রচনা করেন নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। অন্যদিকে কাব্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ একটি দুরূহ ও অপ্রচলিত রচনা হিসেবে স্বীকৃত ছিল, এমনকি রবীন্দ্রনাথও কখনোই এটি মঞ্চায়নে উদ্যোগী হননি! কিন্তু স্বপ্নদলের প্রযোজনাতে নির্মিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ পাণ্ডুলিপিটি অবলম্বনে।
‘চিত্রাঙ্গদা’র নাট্যকাহিনীতে উপস্থাপিত হয়-মহাবীর অর্জুন সত্য পালনের জন্য এক যুগ ব্রহ্মচর্যব্রত গ্রহণ করে মণিপুর বনে এসেছেন। মণিপুর-রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের প্রেমে উদ্বেলিত হলেও অর্জুন রূপহীন চিত্রাঙ্গদাকে প্রত্যাখ্যান করেন। অপমানিত চিত্রাঙ্গদা প্রেমের দেবতা মদন এবং যৌবনের দেবতা বসন্তর সহায়তায় এক বছরের জন্য অপরূপ সুন্দরীতে রূপান্তরিত হন। অর্জুন এবারে যথারীতি চিত্রাঙ্গদার প্রেমে পড়েন। কিন্তু অর্জুনকে পেয়েও চিত্রাঙ্গদার অন্তর দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে-অর্জুন প্রকৃতপক্ষে কাকে ভালোবাসেন, চিত্রাঙ্গদার বাহ্যিক রূপ নাকি তাঁর প্রকৃত অস্তিত্বকে? আর বাহ্যিক রূপ তো চিরস্থায়ী নয়! এভাবে ‘চিত্রাঙ্গদা’ পৌরাণিক কাহিনীর আড়ালে যেন আধুনিককালেরই নর-নারীর মনোদৈহিক সম্পর্কের টানাপড়েন এবং পাশাপাশি পারস্পরিক সম্মানাবস্থানের প্রেরণারূপে উপস্থাপিত হয়। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় সেই অনিবার্য সত্য-বাহ্যিক রূপের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান নারী-পুরুষের চারিত্র্যশক্তি এবং এতেই প্রকৃতপক্ষে আত্মার স্থায়ী পরিচয়! ১০০ বছর আগেও পৃথিবীর কোথাও নারীর ভোটাধিকার পর্যন্ত না থাকলেও প্রায় ১২৩ বছর আগে রচিত ‘চিত্রাঙ্গদা’য় রবীন্দ্রনাথ নারীকে যেভাবে সম্মানের আসনে বসিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে পুরুষের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি প্রসঙ্গও এ নাট্যে যেরূপে এসেছে, তার তুলনা সমগ্র বিশ্বশিল্প বা সাহিত্যে দুর্লভ!
স্বপ্নদলের ‘চিত্রাঙ্গদা’র নির্দেশক জাহিদ রিপন মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাট্যকারমাত্রই ছিলেন না, একই সঙ্গে তিনি ‘নাট্যতাত্ত্বিক’ এবং যে নব্যকালে বাঙালির যে নাট্যতত্ত্বের কথা তিনি তাঁর নানা রচনা ও আলাপচারিতায় প্রত্যাশা করেছেন, তা নিশ্চিতভাবেই উপনিবেশ-উত্তর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাঙালির নিজস্ব আধুনিক নাট্যধারা ‘বাঙলা নাট্যরীতি’র পরিপূরক। নির্দেশক ‘চিত্রাঙ্গদা’য় রবীন্দ্রনাথ-ঈপ্সিত সেই নাট্যরীতির একটি ব্যবহারিক রূপ প্রদানের গবেষণা পরিচালনা করেছেন। তাই ‘চিত্রাঙ্গদা’য় গৃহীত হয়েছে ‘বাঙলা নাট্যরীতি’র সাযুজ্যে চারদিকে দর্শকসমৃদ্ধ আসরকেন্দ্রিক বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতি এবং যেখানে নাট্যের উদ্দেশ্য পূরণে কিছু নৃত্য-গীতেও সমৃদ্ধ হয়েছে উপস্থাপনা, যে আঙ্গিকটি এ প্রযোজনার সঙ্গে অত্যন্ত মানানসই বলে মনে হয়েছে।
‘চিত্রাঙ্গদা’ প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন সুকন্যা (মূল চিত্রাঙ্গদা), মিতা (রূপান্তরিত চিত্রাঙ্গদা), মোস্তাফিজ (অর্জুন), রেজাউল (মদন), শিশির (বসন্ত), সামাদ (বনচর)। এ ছাড়া ছিলেন মাধুরী, শাহীন, জেবু, নাবলু, হিটলার, তানভীর, রিমু, তানিয়া, আলী, জুয়েনা, বিপুল, সাইদ, উজ্জ্বল প্রমুখ। তাঁরা সবাই চরিত্রানুগ ভালো করেছেন, তবে কারো কারো উচ্চারণে এবং সংগীত-আবহদলে আরো কিছুটা অভিনিবেশ কাম্য। প্রযোজনাটির মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা ফজলে রাব্বি সুকর্ণ এবং কোরিওগ্রাফি পরিকল্পনা ফারজানা রহমান মিতা। সর্বোপরি, স্বপ্নদলের ‘চিত্রাঙ্গদা’ একটি মনোমুঙ্কর প্রযোজনা নিঃসন্দেহে। সৎ শিল্পের কাছে আমাদের প্রকৃত প্রত্যাশা তো এটাই!
You must be logged in to post a comment.