সুজানা জাফর। করেছেন ৩৫টির মতো টিভিসি, যার প্রতিটিই এসেছে আলোচনায়। দীর্ঘ বিজ্ঞাপন ক্যারিয়ারে দুই দফা বিরতির পরও এখনো তুঙ্গে রয়েছে সুজানার জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা। এই বিজ্ঞাপন তারকাকে নিয়ে লিখেছেন মাসিদ রণ। ছবি তুলেছেন শামছুল হক রিপন ।
ফটোগ্রাফার চঞ্চল মাহমুদের ক্যামেরায় একটি ফটোসেশন করিয়েছিলেন সেই ২০০১ সালে। সেই ছবি কিভাবে যেন গিয়ে পড়ে গুণী অভিনেতা ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা আফজাল হোসেনের হাতে। আর যায় কোথায় সুজানা? আফজাল হোসেন ডেকে পাঠান তাঁকে।
সানক্রেস্ট কোলার টিভিসিতে মডেল হতে হবে। কিন্তু ছবিতে যে মেয়ে অনিন্দ্য সুন্দরী, যাকে দেখলে তারুণ্যদীপ্ত মনে হয়, সেই সুজানা বাস্তবে যে একেবারেই গোবেচারা! কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারেন না। তিনি কিভাবে মডেলিং করবেন! কিন্তু আফজাল হোসেন নাছোড়বান্দা। বললেন, ‘দেখো, এটা কঠিন কিছু নয়। টিভিসিতে অনেক মানুষ থাকবে। তুমি ওদের বন্ধু ভেবে মজা করবে।’
অগত্যা রাজি হলেন সুজানা। মিশন সাকসেসফুল। তাঁর আরেকটা স্বভাবে মুগ্ধ আফজাল। স্কুলে বিজ্ঞানে পড়া মেধাবী ছাত্রী কখনো পড়াশোনা ফাঁকি দিতেন না। মানে যা করবেন, মন দিয়েই করবেন। খাঁটি জহুরির চোখ দিয়ে আফজাল তাঁর এই গুণ ঠিকই ধরে ফেললেন। ফলে সানক্রেস্টেরই পরের টি
ভিসিতে সলো পারফরমার হিসেবে আবারও সুজানা। এরপর আর সুজানাকে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কিন্তু যে সুজানা বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ ছাত্রী ছিলেন, তিনি মডেল হলেন কেন? ‘আসলে আব্বু-আম্মু চাইতেন আমি ডাক্তার হব। সে জন্যই বিজ্ঞানে পড়েছি এসএসসিতে। কিন্তু যে-ই না প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে জীবজন্তু কাটাকাটি করতে হলো, আমি তো রক্ত দেখে একেবারেই অজ্ঞান। তার পর থেকে ডাক্তার হওয়ার বাসনা বাদ।’ বলছিলেন সুজানা। পরে অবশ্য অ্যাকাউন্টিং নিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন। ব্যাংকার হওয়ার ইচ্ছা তাই এখনো মরে যায়নি।
কিন্তু বিজ্ঞাপন জগতে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা এই সুতন্বীকে আপাতত সেই ভাবনা থেকে বিরত রাখছে। দুই বছর আগে পর্যন্ত মিডিয়ার কাজ নিয়ে তেমন কোনো প্ল্যান ছিল না। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পড়াশোনার ফাঁকে শুধু বিজ্ঞাপনের মডেলই হয়েছেন। ২০০৫ সালেই বাংলালিংকের প্রথম বিজ্ঞাপনের মডেল হন। এটি নির্মাণ করেন অমিতাভ রেজা। এরপর তিন বছরের বিরতি। তখন অভিনয়ও তাঁকে টানত না। ‘আমি অভিনয়টা পারতাম না। আর যা পারব না, তা কেন করব? এ ভাবনাটা আমাকে আরো বেশি পারফেকশনিস্ট করেছে। ফলে কম কাজ করেও সারা বছর আমি দর্শকের মনের ভেতরই থেকেছি।’
২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো করেন গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনচিত্র। পরের বছরই দুই বছরের চুক্তি হয় কেয়া কসমেটিকসের সঙ্গে। এ সময় কেয়ার আটটি টিভিসিতে মডেল হন।
‘কেয়ার টিভিসিগুলো আমার ক্যারিয়ারকে অন্য একটা মাত্রা দেয়। তখন এত নিউজ, দর্শক সাড়া পেয়েছি, যা অকল্পনীয়।’ বললেন সুজানা।
কেমন ছিল সেই জার্নিটা? প্রশ্ন শুনেই স্মৃতির সমুদ্রে সুজানার সাঁতার কাটা শুরু-‘টিভিসিগুলোর বেশির ভাগ শুটিং হয়েছিল নেপালে। অনেক মজা হয়েছিল। কিন্তু আরেকটু হলে মরেই যেতাম। একটি টিভিসিতে আমাকে সাইকেল চালাতে হবে। আমি তো খুব খুশি। কারণ আমি সাইকেল চালাতে ভীষণ পছন্দ করি। যা-ই হোক, শট শুরু হলো, আমি সাইকেলে করে নামছি পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের দিকে। কিন্তু হঠাৎ দেখি সাইকেল ব্রেক নিচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করে কিছুতেই ব্রেক কষতে পারছি না। সরু পাহাড়ি রাস্তার একটু এদিক-সেদিক হলেই পটল তোলা সাড়া। পরে আবার অবস্থা বেগতিক দেখে প্রোডাশনের একটা মেয়ে দৌড়ে গিয়ে সাইকেল টেনে ধরল। আমি তো মেয়েটার গায়ের ওপর পড়লাম। ও খুব জখম হয়েছিল। কোমরেও খুব ব্যথা পাই, অনেক দিন ভুগেছি।’
বাবার ক্যান্সারের জন্য আবারও বিরতি নেন ২০১১ সালে। এবার ফিরে আসেন দুই বছর পরই। ২০১৩ সালে নিয়মিত কাজ শুরু করেন টিভিসি ও নাটকে। তবে এরপর তাঁর বিয়ে, সংসারে ভাঙন-এসব নিয়ে কেন যেন ছন্দে ফিরতে পারছিলেন না সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মডেল। কিন্তু গত মাস থেকেই জীবনের একটা অধ্যায় পেরিয়ে শুরু করেছেন নতুন এক অধ্যায়।
যেখানে ভরা থাকবে শুধু মাইলফলক হয়ে থাকার মতো কাজ। ‘আমার ভাবনা, স্বপ্ন সব এখন ছেয়ে আছে মিডিয়ার কাজ নিয়ে। একসময় এটাকে ততটা গুরুত্ব দিইনি। তবু আমাকে দর্শক পছন্দ করে বলেই একের পর এক বিগ বাজেটের গ্ল্যামারাস সব টিভিসিতে মডেল হয়েছি। আর এখন সেই সময়টা নেই। এখন কোনো সুযোগ হেলায় হারাতে চাই না। নিয়মিত কাজ করতে চাই। তবে অবশ্যই আগের মতো কোয়ালিটিফুল কাজই করব।’ এমনই দৃঢ় প্রত্যয় তাঁর কণ্ঠে।
বিজ্ঞাপনের দুনিয়া সম্পর্কে সুজানা বলেন, ‘বিজ্ঞাপন জগত অনেক বদলেছে। আগে ভালো নির্মাতা ছিল হাতে গোনা। ভালো নির্মাতার অভাবে আমি অনেক বিজ্ঞাপন করেছি ভারতীয় পরিচালকদের সঙ্গে। সেগুলো
হিটও করেছে। কিন্তু আমার নিজের পছন্দের কাজ এখনো করতে পারিনি। আগে গ্ল্যামারনির্ভর ও মডেলনির্ভর টিভিসি হতো। সাজ-পোশাক ও উপস্থাপনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত মেকআপ-গেটআপ দিয়ে আমাকে পুতুলের মতো বানিয়ে ফেলা হতো। এখন তেমনটি নয়। বিজ্ঞাপনের গল্পটাই এখন হিরো। এখনকার উন্নত প্রযুক্তি ও রুচিশীল নির্মাতার সঙ্গে কাজ করে আমি ওই ক্ষুধাটা মেটাতে চাই, যা নতুন সুজানাকে দর্শকদের কাছে তুলে ধরবে।’
কথা শেষ হয়েও যেন হয় না শেষ। আরো যোগ করেন সুজানা, বর্তমানে বেশির ভাগ টিভিসিতে তারুণ্যের উপস্থাপনটা কেমন যেন এলোমেলো। সেটা হয়তো তারুণ্যের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসকে বোঝানোর জন্য। তবে যাদের সবাই অনুসরণ করে, ফ্যাশন, ট্রেন্ড ইত্যাদি ফলো করে তাদের একটু গুছিয়ে উপস্থাপন করতে পারলে ভালো। বিজ্ঞাপনগুলো নির্মাতা ও গল্পনির্ভর হওয়ায় জনপ্রিয় মডেল তৈরি হচ্ছে না। আমি চাই আগের মতো মডেলনির্ভর কাজগুলোও থাকুক। কিছুটা হলেও সেই পুরনো ঐতিহ্য ফিরে আসুক।’
এক নজরে সুজানার হিট টিভিসি
সানক্রেস্ট কোলার দুটি, কনকা ফ্রিজ, লাক্স বডি ওয়াশের প্রথম টিভিসি, গ্রামীণফোন, প্যানাসনিক এসি ও ফ্রিজ, ফ্রেশ ওয়াটার, মার্কস গুঁড়া দুধ, তিব্বত স্নো ও পাউডার, কুল সেভিং ক্রিম, ম্যাটাডোর পেন ও ব্রাশ, হুইল সাবানের তিনটি, থাই নুডলস, প্রাণ টোস্ট, আশিয়ান সিটি, ডাবর মেসওয়াক টুথপেস্ট, সজীব আটা-ময়দা সুজি ও সর্বশেষ আরএফএল আয়রন।
You must be logged in to post a comment.