২০১১ সালে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম সার্ধশত বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার কবিগুরুর সাহিত্য নিয়ে মঞ্চনাটক নির্মাণের জন্য বেশ কিছু নাট্যদলকে অনুদান দিয়েছিল। বাজেট বেশি না থাকায় এর মধ্যে বেশির ভাগ নাটকই খুব একটা আশা জাগাতে পারেনি। তবে যে কটি নাট্যদলের প্রযোজনায় বহুরূপী রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে একটি পদাতিক-বাংলাদেশ। তারা অনুদানের অর্থ দিয়ে ৩০তম প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে আনে রবীন্দ্রনাথের ভিন্ন ধারার গল্প ‘সে’ অবলম্বনে নাটক ‘সে’। এটি দৃশ্যতই একটি ভিন্ন ধারার গল্প। কারণ এখানে অ্যাবসার্ট অনেকগুলো চরিত্র এসেছে মূর্তমান হয়। অর্থাৎ কবি তাঁর মননে লালিত স্বপ্ন নিয়ে খেলেছেন। তাকে কবি খুঁজে ফেরেন, পেয়ে যান, নতুন আবেশে জড়ান, খেলা করেন নিজের মতো করে। যেন তাঁরই আজ্ঞাবহ পুতুল ওই কল্পনা।
আসলেই তাই। মানুষ মাত্রই কল্পনাবিলাসী। স্বপ্নলোকের ঝরনাধারায় স্নানের আহ্লাদ থেকেই মানুষ নিত্যই কল্পনার অতলে নিমজ্জিত হয়, মনের সবটুকু রংতুলিতে ভরিয়ে সে এঁকে যায় আপন দৃশ্যপট। হোক তা সে জলরং বা অ্যাক্রেলিক, তার সবই যেন কাঠপেনসিলের পশ্চাতে থাকা রাবার দিয়ে ঘষে তোলা যায়। মানে যত অসম্ভব কল্পনাই আমরা করি না কেন, তা যেন মনের মতো না হলে আবার সব ধুয়ে সাফাই করে নতুন ঢঙে তাকে আঁকি সারা বেলা। এসব কর্মযজ্ঞে নেই কোনো বাধা, নেই কোনো সংশয়ের বালাই বা কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কারণ এগুলো যে বিমূর্ত, অস্তিত্বহীনেরে কেনই বা তোয়াক্কা করি।
আর যদি তা হয় কবির মন, রবি ঠাকুরের মন, তাহলে ওই ভাবনার অবকাশ কোথায় না যেতে পারে। এ জন্যই তো কল্পনার মধ্যে কল্পনাকে ঠাঁই দেন তিনি, যার প্রত্যক্ষ ফল লক্ষ করা যায় তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি ‘সে’ গল্পে। এখানে কবি নিজের অ্যাবসার্ট ভাবনার সঙ্গে পাঠকের সুসমন্বয় করতে দাদা আর কিশোরী নাতি-পুতিকে এনেছেন গল্পে। যে নাতি লেখক দাদার কাছে সময় নেই অসময় নেই শুধু গল্প শুনতে বায়না ধরে। আদরের নাতনির আবদার রাখতে দাদাও লিখে ফেলেন এক মজাদার গল্প। গল্পের নায়ক ‘সে’। এটা তাঁর নাম। কারণ হিসেবে কবি দেখিয়েছেন সে হলো এমন এক চরিত্র, সে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, যাকে দিয়ে আমি আর তুমি অর্থাৎ দাদা আর তাঁর নাতনি-পুতি ছাড়া অন্য সবাইকে বোঝানো যায়। এই ‘সে’ গল্পের প্রযোজনে ‘শিয়ালকে মানুষ করার পরীক্ষায় নামে’, ‘কৃষ্ণকলি কন্যাকে বিয়ের জন্য দেখতে চায়’, ‘ঘটনার আকস্মিকতায় নিজের দেহ বদলে যাওয়ায় নানা রকম বিড়ম্বনায় জড়িয়ে পড়ে’, ‘শরীর হারিয়ে অস্তিত্বহীন ‘সে’র জীবনে চরম দুর্দশা নামে’, আবার ‘ক্ষ্যাপাটে ডাক্তারের এক্সপেরিমেন্টের স্বীকার হয়ে নিজের মাথায় বানরের মস্তিষ্ক নিয়ে ঠাঁয় না পায় মানুষের দরবারে, আবার বানর সমাজও তাঁকে টিকতে দেয় না।’ ‘সে’র অবস্থা যখন এই তখন সে ফিরে আসে গল্পকার দাদুর কাছে। তাঁর কাছে কান্না জুড়ে বসে। হাজার হোক দাদুই তো তাঁর স্রষ্টা। তাই দাদুর কাছে সে মিনতি করে যেন সে আবারও তার প্রথম জীবনের মতো সম্মানসূচক পৃথিবীতে ফিরতে চায়। কিন্তু দাদু তত দিন গল্প লিখতে লিখতে বড্ড ক্লান্ত। তাই তিনি যখন কিছুই করতে চান না, তখন ‘সে’ নিজেই অজানায় হারিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এই মুহূর্তে ‘সে’র জীবনের সব চরিত্র তাঁকে ঘিরে ধরে আর তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে। পাঠক হৃদয়ে নেমে আসে এক অনাবিল আনন্দ। আবার এর আগে ‘সে’র দুর্দশায় পাঠক কষ্টও পায়। কিন্তু ‘সে’ কোনো মানুষই নয়, তার অস্তিত্ব পৃথিবীতে বিমূর্ত। এই নিরাকারকে নিয়ে পাঠকের আবেগের নানা রস আদায় করাটাই বোধ হয় কবিগুরু রবি ঠাকুরের লেখনীর সার্থকতা। যার কিছুটা ভাগীদার হয়েছেন এ সময়ের মঞ্চ নির্দেশক দেবাশিষ ঘোষ।
তিনিই ‘সে’ মঞ্চসৃজনের নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন, যার মাধ্যমে সাবলীলভাবে পুরো গল্পের আবহ উঠে এসেছে। গত ৩০ মার্চ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে নাটকটির দ্বাদশ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন নাসিরুল হক খোকন ও মঞ্চ পরিকল্পনায় সেলিম শামসুল হুদা চৌধুরী। চরিত্রানুযায়ী সাবলীল রূপসজ্জা করেছেন শুভাশিষ দত্ত তন্ময়। মূল চরিত্রে অভিনয়কারী এস পি অরণ্য মূলত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য। তিনি দারুণ অভিনয় করে অতিথি শিল্পীর মান রেখেছেন। আরো অভিনয় করেছে শিশুশিল্পী কলি, মিজান, কামাল, মামুন, ফয়সাল, পাভেল, ডলি, আল আমিন, আজিজ, ডিউক ও শাকিল।
লিখেছেন-মাসিদ রণ