বিনোদন

কলকাতার নাটক ‘অশোকানন্দ’


masid rono1কলকাতা থেকে কোনো দল নাটক নিয়ে এলে এখনো ঢাকাই মঞ্চের দর্শকরা একটু বেশিই আগ্রহ দেখান নাটকটির ব্যাপারে। এত দিন এর কারণ হিসেবে বিবেচ্য হতো, তাদের নাটকের মান আমাদের নাটকের চেয়ে ভালো। তা ছাড়া তাদের মঞ্চ উপস্থাপনের ভঙ্গি ও অভিনয়শৈলীর প্রাজ্ঞতার ব্যাপারটি বিবেচনা করতেন দর্শক। তবে আস্তে আস্তে এ ধারণার পরিবর্তন হবে আশা করি। গত ৪ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ‘গঙ্গা-যমুনা’ নাট্যোৎসবেও ভারত থেকে দুটি দল এসেছিল। এর মধ্যে ভারতের জনপ্রিয় মঞ্চনাটকের দল অনীকের নাটকও ছিল। দর্শকও খুব আশাবাদী হয়ে নাটক উপভোগ করতে গিয়েছিল শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে গত ৯ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যায়। কিন্তু নাটক শেষে তাঁদের মুখে সেই প্রত্যাশা পূরণের তৃপ্তি পাওয়া যায়নি।

অনীক যে প্রযোজনাটি মঞ্চায়ন করে, তার নাম ছিল ‘অশোকানন্দ’। মূল কাহিনী বাংলাদেশেরই সন্তান ড. মুকিদ চৌধুরীর। নাট্যরূপ দিয়েছেন এই দলের অধিকর্তা অমলেশ চক্রবর্তী। আর নির্দেশনায় ছিলেন অরূপ রায়। নাটকের কাহিনী এক রাজপরিবার ঘিরে। অভিনয়ে শিল্পীরা যাত্রা ঢংকে ঈষৎ অপরিহার্য করেছেন। অশোকানন্দ ভারত ইতিহাসের এক অলিখিত অধ্যায়। ইতিহাস-আশ্রিত হলেও মুনীর চৌধুরীর সফল নাট্যাখ্যান ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’-এর মতো এ নাটকও ঐতিহাসিক নাটক নয়। এ আখ্যানে নায়ক অশোকানন্দ শুধু পিতৃশোকে বিহ্বল ও বিপদগ্রস্ত তরুণের প্রতিশোধস্পৃহাতাড়িত এক ট্র্যাজেডি নয়। বস্তুত নায়কের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি পরিণত হয় সমাজ ও জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া বিবিধ নৈতিক প্রশ্ন ও সংঘাতের এক সংক্ষুব্ধ উৎসস্থল; এক নিকৃষ্ট প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বলি। ষড়যন্ত্রের এই বিষাক্ত পরিবেশ পরিণামে তাকে নিমজ্জিত করে এমন এক অস্তিত্বসংকটে, যাতে সে ভাবতে বাধ্য হয় ‘বেঁচে থাকাটাই বৃথা’। ফলে দিশাহীন সময়ে সমগ্র জাতি তার কাছে হয়ে ওঠে ষড়যন্ত্রে ভরা এক ভণ্ডামি ও হিংসার কারাগার। তাই মন্ত্রীকন্যা অপরাজিতার সঙ্গে তার মধুর প্রেমও বলিপ্রাপ্ত হয়। কখনো বা স্বনির্দেশিত নাটকের মাধ্যমে আসল সত্যকে তুলে ধরে পিতার হত্যাকারী রাজা ও ছলনাময়ী মাতাকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। ঘটনার রসদ দানকারী মন্ত্রীকে এক রাতে খুন করে অশোক। একদিকে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ, অন্যদিকে প্রেমিক-কাউকে বেছে নিতে না পেরে অপরাজিতা আত্মহননের পথ বেছে নেয়। একপর্যায়ে মন্ত্রীর অপরাধ ছিল জেনে তার পুত্র শান্ত হয়। কিন্তু অশোকের বুকের জ্বালা শান্ত হয় না, যতক্ষণ তার পিতৃহত্যাকারী বেঁচে আছে। অবশেষে সত্যের জয় হয়। শুধু যে মাতাকে অশোক ছলনাময়ী ভেবেছিল, পরিশেষে তাকে সে চিনতে পারে। সে বুঝতে পারে, নারীরা শুধুই পদভার অলংকৃত করে। তারা থাকে সময় আর ক্ষমতার দাসী হয়ে। এ জন্যই দেবর সূর্যগুপ্তের সঙ্গে তার সংসার যাপন করতে হয়েছে।

নাটকের গল্প উত্তেজনাপূর্ণ হলেও পাত্র-পাত্রীদের দুর্বলতাই বোধ হয় শেষ পর্যন্ত দর্শকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজা-রানি চরিত্রের অভিনয়শিল্পীরা সাবলীল। অশোক চরিত্রের অভিনেতা চলনসই। তবে তার প্রেমিকা অপরাজিতা একেবারেই আনাড়ি। আর মন্ত্রীর চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতার বাচিক অভিনয় ভীষণ বিরক্তি দেয়। এ ছাড়া নাটকের পোশাক ও অঙ্গসজ্জা একেবারেই এই সময়ের সঙ্গে বেমানান। কাহিনী পুরনো হলেও যেহেতু সেই সময়কার পোশাককে ইম্প্রোভাইস করা হয়েছে, তাহলে তা সময়োপযোগী হতে পারত। অর্থাৎ পোশাক ডিজাইনে চলতি ট্রেন্ড অনুসরণ করা যেত। আর একটি ব্যাপার খুবই হতাশার, তা হলো-খুব কম সময়ের ব্যবধানে দৃশ্যের শেষ ও শুরু। এতে বারবার মঞ্চ ব্ল্যাক-আউট হয়েছে আবার মঞ্চ-সজ্জার পরিবর্তন এসেছে, যা দর্শক গল্পের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে খানিকটা বেগ পাচ্ছিল। সব মিলিয়ে নাটকটি ভারতের নাটক হিসেবে আশা জাগানিয়া ছিল না। অভিনয় করেছেন অরূপ রায়, অংশুমান দাশগুপ্ত, সন্তোষ রায়, দিলীপ মজুমদার, সুচিত্রিতা ঘোষ, শুভ্রা বোস, সন্ধ্যা দোয়ারী প্রমুখ।

ছবি : রাজীব হালদার