মাসিদ রণঃ নান্দনিক শিল্প সৃজন সর্বমহলে স্বীকৃত। তার সঙ্গে সমসাময়িক আবেদন শিল্পকে দান করে পার্থিব যোজনা। ছোটবেলায় শুনে থাকা রূপকথা বা এ সময়ে নির্মাণাধীন হলিউডের অবাস্তব বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক মুভি একেকটি নান্দনিক শিল্পের উদাহরণ। কিন্তু এর মধ্যে যেগুলোতে সমসাময়িকতার স্বাদ রয়েছে, সেগুলো শ্রোতা বা দর্শক হৃদয়ের আলাদা একটা স্থান দখল করে, যা সব ধরনের শিল্প দাবি করতে পারে না। সম্ভবত তেমনই একটি মঞ্চ ফসল অবয়ব নাট্যদলের ২৩তম প্রযোজনা ‘ফেরিওয়ালা’। না, প্রযোজনাটির নামকরণ যথেষ্ট সমসাময়িক। যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত স্বপ্নের ফেরি করি, কেউ-বা ফেরি করে কথা, কেউ-বা গায়ের শক্তি আবার কেউ ফেরি করে ভালোবাসা। সেখানে ‘ফেরিওয়ালা’ শীর্ষক মঞ্চনাটক দর্শকের মনে অগ্রিম উত্তেজনা জাগাতেই পারে।
‘ফেরিওয়ালা’ নাটকের কাহিনী একদিকে যেমন বর্তমান বাংলাদেশ বা বহির্বিশ্বের কোনো চলমান ইস্যুর প্রতিনিধিত্ব করে না, তেমনি তা কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনারও নির্দেশ করে না। তাই দর্শককে নাট্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে চলে যেতে হয় এই বঙ্গদেশের ফেলে আসা একটি নির্দিষ্ট সময়ে। যেখানে ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে দিনাতিপাত করছে। একে তো সে সময় সম্ভ্রান্ত হিন্দু ও মুসলিম সমাজেরই কোনো ঘটনা ছিল না, তার ওপর আবার চাঁড়াল সম্প্রদায় এ নাটকের প্লট। দেখানো হয় তখনকার চাঁড়াল সমাজের চরম দৈন্যদশার খণ্ডচিত্র। সেই সঙ্গে একটি গল্প চলে আসে নাটকে। তা হলো- ফেরিওয়ালার গল্প। এই ফেরিওয়ালা ফেরি করে ঠিকই; কিন্তু তা প্রচলিত নিয়মে নয়। এখানে এক ইংরেজ সাহেব আসেন চাঁড়াল সম্প্রদায়ের বহু বছরের পুরনো ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস কিনতে। তাঁকে বরাবরের মতো সাহায্য করে এ দেশীয় দালাল।
এই গল্পে দালাল থাকে এলাকার মেম্বার। সে চাঁড়াল সম্প্রদায়ের বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে পুরনো জিনিস যৎসামান্য দামে ক্রয় করে তা চড়া দামে পাচার করে ইংরেজ সাহেবের কাছে। আর এই মেম্বার সাহেবের মাঝখানে সেতু হিসেবে কাজ করে ফেরিওয়ালা। ঘটনার একপর্যায়ে মেম্বার নীলকণ্ঠী নামের এক বৃদ্ধ চাঁড়ালের একটা ত্রিশূল কিনতে চায়। অভাবের জ্বালা দূর করতে নীলকণ্ঠীর ছেলে লখাই ত্রিশূল বেচতে রাজি হয়। কিন্তু বেঁকে বসে নীলকণ্ঠী। সে কিছুতেই ওই ত্রিশূল বেচবে না। ওটা যে নীলকণ্ঠীর পূর্বপুরুষের বহু আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক। নীলকণ্ঠীর কাছে ওই ত্রিশূলের মধ্যেই বেঁচে আছে তার বাপ-ঠাকুরদা। একপর্যায়ে অভাবের তাড়নায় ও মানুষের কুরিপুর প্রভাবে গ্রাস হয়ে লখাই ত্রিশূল বিক্রি করতে বাবা নীলকণ্ঠীকে বাধ্য করে।
কিন্তু নিজের চোখের সামনে সে ওই ত্রিশূল হাতছাড়া হতে দেবে না। তাই ত্রিশূলটি দিয়েই নীলকণ্ঠী আত্মহত্যা করে। মেম্বার লখাইকে পরামর্শ দেয়, বাবার বুক কেটে ত্রিশূলের ফলা বের করে দ্রুত বিক্রি করতে। কিন্তু ততক্ষণে বাবার মৃত্যুতে লখাইয়ের বোধ জাগ্রত হয়েছে। সে মেম্বারের কুচক্রের বিরোধিতা করে। অবশেষে মেম্বার তাঁর স্বার্থসিদ্ধির জন্য লখাইকেও হত্যা করে ত্রিশূল হস্তগত করে। এভাবেই নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এই গল্পকে নির্দেশক শহিদুল হক খান শ্যানন দর্শকের কাছে আনতে এরিনা থিয়েটারের (তিন পাশে দর্শক, এক পাশ কলাকুশলীর যাতায়াতের জন্য বরাদ্দ) ব্যবহার করেছেন। তাই প্রসেনিয়ামের যুগে নাটকটি দর্শকদের আলাদা একটা স্বাদ দেয়। তা ছাড়া আপস্টেজের পাশ দিয়ে জাল টাঙিয়ে গল্পের পাত্র-পাত্রীর পেশা বা জীবনপ্রণালি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন মঞ্চসজ্জাকর রবীন্দ্রনাথ প্রামাণ্য।
আর অল্প চরিত্রের সমাগমে পাত্র-পাত্রীর সাবলীল অভিনয় দর্শককে ধরে রেখেছে। অভিনয় করেছেন মাহমুদ হাসান জনি, কাজী দেলোয়ার হেমন্ত, ফ্রাংকোলিন সরকার, আবু সাঈদ, নিবিড় ও হান্নান। এ ছাড়া লাইভ মিউজিকের দ্যোতনা নাটকটি ভালোলাগার আরেকটি উপাদান। আবহ সংগীতে ছিলেন আলমগীর, আবু হাসান ও জীবন। পরিমিত আলোক সঞ্চালন করেছেন অনীক রহমান।
এ সব কিছুর মিশেলে অবয়বের ‘ফেরিওয়ালা’ নাটকটি একটি পরিশীলিত মঞ্চ ফসল বলেই মনে হয়েছে। তবে সমসাময়িকতার ছোঁয়া নাটকটিকে অন্য মাত্রা দিতে পারত…