বাঙালির প্রাণের উৎসবে পোশাকটা হতে হবে ঐতিহ্যবাহী। হতে পারে সুতি, তাঁত, মসলিন, জামদানি বা সিল্ক। দেশীয় এসব শাড়ি-পাঞ্জাবির নকশা, রং ও ট্রেন্ড নিয়ে এ আয়োজন
প্রতিবারের মতো এবার বৈশাখে সুতি শাড়িতে থাকছে ফোক মোটিফ। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস তাদের নির্বাচিত মোটিফ নিয়ে কাজ করেছে। কে ক্র্যাফটের সুতি শাড়ির কালেকশনে ফোক মোটিফ বেশি চোখে পড়ে। কিছু ফ্লাওয়ার মোটিফও থাকছে। শাড়িতে বুনন ডিজাইনে থাকছে ইক্কাত, চেক, ডবি ও জ্যাকার্ড ডিজাইন। নকশায় পাবেন ব্লকপ্রিন্ট, স্ক্রিনপ্রিন্ট, অ্যাল্পিক, হাজার বুটির কাজ। কিছু শাড়িতে এমব্রয়ডারি কাজ দেখা যাবে। ডিজাইনার নাদিরা ফেরদৌসী জানালেন, লাল-সাদার সঙ্গে ঋতুভিত্তিক উজ্জ্বল রং ব্যবহার করা হয়েছে। এবার বৈশাখে সুতি শাড়িকেই প্রাধান্য দিয়েছে ফ্যাশন হাউস অঞ্জন’স। নরসিংদী, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুতি শাড়িতে থাকছে নানা নিরীক্ষা। রং, ডিজাইন ও নকশাকে প্রাধান্য দিয়ে করা হয়েছে বৈশাখী শাড়ি। স্ক্রিনপ্রিন্টের সঙ্গে মেশিন ও হ্যান্ড এমব্রয়ডারি করা হয়েছে। অ্যাপ্লিক, টাইডাই ও ব্লকের কাজও চোখে পড়ে। শাড়ির পাড়ের কাজ আলাদা করে গুরুত্ব পেয়েছে। জরিপাড় ব্যবহার করা হয়েছে কিছু শাড়িতে। সুতি শাড়িতে আলাদা করে লেস বসানো পাড়ও নজর কাড়বে।
বৈশাখে বেশি বৈচিত্র্য খুঁজে পাবেন টাঙ্গাইল শাড়িতে। ঐহিহ্যবাহী বুননের পাড় ও নকশায় থাকছে ভিন্নতা। তাঁত শাড়ির পাড়ে লাল বা গাঢ় রঙের শেড, জমিনজুড়ে লাল, ম্যাজেন্টা আর হলুদের টানা স্ট্রাইপ। এ ছাড়া পাড় দেওয়া টাঙ্গাইল শাড়িতে করা হয়েছে ব্লক, টাইডাই ও হাতের কাজ। কিছু টাঙ্গাইল শাড়িতে সুতার বুননের পাশাপাশি এমব্রয়ডারি, অ্যাপ্লিক টাইডাই ও স্ক্রিনপ্রিন্টের কাজ করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে উৎসবের আমেজ। ফ্যাশন হাউস রঙ টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে বেশ নিরীক্ষা করেছে। তাঁতে বোনা শাড়িতে প্যাটার্ন বেইজ কাজ চোখে পড়ে। কখনো শুধু এমব্রয়ডারি, ব্লক বা স্ক্রিনপ্রিন্ট। আবার কখনো একাধিক মাধ্যমের ব্যবহার হয়েছে একসঙ্গে। ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানা টাঙ্গাইলের কোটা শাড়িতে সরু পাড় ব্যবহার করেছে। তাদের এবারের বৈশাখে সিলেটের রিকশার মোটিফের বিভিন্ন নকশা থাকছে ডিজাইনে। ডিজাইনার লিপি খন্দকার বললেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়িতে সুতার বুননের সরু পাড়ের সঙ্গে স্ক্রিনপ্রিন্ট, এমব্রয়ডারি ও ব্লকের কাজ করেছি। রঙের ক্ষেত্রে বৈশাখে সাদা-লালের কোনো বিকল্প হতে পারে না। তাই লাল-সাদার সঙ্গে রিকশার নকশা থেকে নেওয়া কিছু রঙের সীমিত ব্যবহার করেছি।’
বৈশাখী শাড়িতে অনেকেরই প্রথম পছন্দ সিল্ক। রঙ, কে ক্র্যাফট, বিবিয়ানা, আঞ্জন’স, বাংলার মেলা, অন্যমেলাসহ সব ফ্যাশন হাউসও তাই বৈশাখী কালেকশনে সিল্কের শাড়ি প্রাধান্য দিয়েছে। বলাকা, এন্ডি সিল্ক, রাজশাহী সিল্ক, গরদ, ধুপিয়ানসহ বিভিন্ন সিল্ক বেইজ কাপড়ে করা হয়েছে শাড়ি। ব্লক, স্ক্রিনপ্রিন্ট, এমব্রয়ডারি, চুমকি, পুঁতি, হ্যান্ড এমব্রয়ডারি ও নকশি কাঁথার কাজ করা হয়েছে শাড়িতে। শাড়িতে আলাদা পাড়, প্যাঁচওয়ার্ক, কারচুপি ও আঁচলে টারসেল ব্যবহার করে জমকালো ভাব তৈরি করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী লাল পাড়ের সাদা জমিনের সিল্কের শাড়িতে স্ক্রিনপ্রিন্টের সঙ্গে এমব্রয়ডারি কাজ বৈচিত্র্য এনেছে। আদি বাংলা বর্ষপঞ্জির মোটিফ থাকছে ফ্যাশন হাউস রঙের বৈশাখী শাড়িতে। দেশীয় সিল্কের শাড়িতে স্ক্রিন, ব্লকপ্রিন্ট, হ্যান্ড ও মেশিন এমব্রয়ডারি, কারচুপি ও প্যাচওয়ার্কের কাজ করা হয়েছে। ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বললেন, ’গর্জিয়াস লুক এনেছি সিল্কের শাড়িতে। কিছু শাড়িতে হ্যান্ড পেইন্ট করে তার ওপর এমব্রয়ডারি ও কারচুপির কাজ করা হয়েছে। প্যাঁচওয়ার্ক ও কারচুপির কাজ সিল্কের শাড়িকে আরো গর্জিয়াস করেছে। লাল-সাদার পাশাপাশি অন্যান্য উজ্জ্বল রং ব্যবহার হয়েছে শাড়িতে।
মসলিন
মসলিন শাড়িতে শেডওয়ার্ক, ভারী চুমকির কাজ, কারচুপি ও মেশিন এমব্রয়ডারি, প্যাঁচওয়ার্ক করেছে ফ্যাশন হাউস কে ক্র্যাফট। মোটিফ হিসেবে নেওয়া হয়েছে পটচিত্র, ট্রাইবাল , গ্রিক আর্চ ও ফ্লাওয়ার। শুধু বৈশাখ নয়, অন্যান্য উৎসবে ব্যবহার করা যাবে মসলিন শাড়িগুলো। রঙের মসলিন শাড়িতে এমব্রয়ডারি, কারচুপি ও স্ক্রিনপ্রিন্টের কাজ হয়েছে। বৈচিত্র্য আনতে শাড়ির পাড়, আঁচল ও কুঁচিতে আলাদা রঙের মসলিন কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে। মসলিনের সঙ্গে সিল্কের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে কিছু শাড়িতে। ভারী এমব্রয়ডারি বা হাতের কাজের আলাদা পাড় বসানো কাটওয়ার্কের মসলিন শাড়িতে জমকালো ভাব এসেছে ষোলআনা। অঞ্জন’সের ডিজাইনার শাহীন আহমেদ বললেন, মসলিনের রং এমনিতেই খুব উজ্জ্বল হয়। এর সঙ্গে এমব্রয়ডারি, অ্যাপ্লিক ও কারচুপির কাজ খুব ভালো মানায়। কিছু শাড়িতে হ্যান্ডপেইন্ট ও স্ক্রিনপ্রিন্টের কাজ করা হয়েছে।
জামদানি নিয়ে বেশকিছু ব্যতিক্রমী কাজ করেছে ফ্যাশন হাউস জারিফ। বৈশাখের লাল-সাদা মোটিফে আলাদা পাড় ও আঁচল ব্যবহার করা হয়েছে শাড়িতে। জামদানির সঙ্গে মসলিন, কাতান এমনকি জর্জেটের ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ফ্যাশন হাউস আড়ং, কুমুদিনি, মায়াসির বৈশাখী জামদানি শাড়ি ডিজাইন করেছে। কলকা, জরি বুটি, বৃষ্টি, জিগজ্যাগসহ ঐতিহ্যবাহী নকশা থাকছে শাড়িতে। কিছু জামদানি শাড়িতে অ্যাপ্লিকের কাজও চোখে পড়ে। কটন আর হাফসিল্ক দুই ধরনের ফেব্রিকসই ব্যবহার করা হয়েছে। লাল জমিনে সোনালি ও রুপালি জরি সুতার কাজ গর্জিয়াস ভাব এনেছে। লাল-সাদার সঙ্গে সবুজ, হলুদ, নীল, আকাশি রঙের ব্যবহার চোখে পড়ে। জামদানির মোটিফে বৈচিত্র্য আনতে পাড়ের ওপর টেম্পলের কাজ করা হয়েছে। ভিন্নতা আনতে কিছু শাড়িতে কুঁচি ও বডিতে আলাদা রং ব্যবহার করা হয়েছে।
পাঞ্জাবি
পহেলা বৈশাখের সকালবেলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে কিংবা সন্ধ্যায় নানা নিমন্ত্রণে ছেলেদের চাই পাঞ্জাবি। সকালে হালকা ও আরামদায়ক আর রাতে একটু ভারী কাজের জমকালো পাঞ্জাবি পরা ভালো। অনেকেই বৈশাখে পাঞ্জাবির বেলায় লাল-সাদার বাইরে একটু ভিন্নধর্মী কিছু চান। তাঁদের জন্য লাল-সাদার পাশাপাশি উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি এনেছে ফ্যাশন হাউসগুলো। সুতির পাশাপাশি হালকা কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে পাঞ্জাবিতে। জমকালো ভাব আনতে পাঞ্জাবির কলার, বুক ও হাতে পাইপিং, পুঁতি, স্প্রিং, সুতা ইত্যাদির নকশা করা হয়েছে। রঙের মধ্যে লালচে, কফি, সাদার প্রাধান্য বেশি। সুতির পাঞ্জাবিতে আছে স্ক্রিনপ্রিন্টের কাজ। সেমি লং ও লং দুই ধরনের পাঞ্জাবিই পাবেন। তাঁত, সুতি, লিনেন, সিল্ক, ধুপিয়ান, অ্যান্ডি, মসলিন ইত্যাদি কাপড়ে বানানো হয়েছে পাঞ্জাবি।
You must be logged in to post a comment.