রাস্তার ওপর শাল-সেগুনের লম্বা ছায়া। গা ছমছম করা। অরণ্যের গহিনে ঢুকে যাচ্ছি। সাইনবোর্ডে লেখা-আস্তে চলুন, সামনে হাতি চলাচলের পথ। বাইসনও দেখা দিতে পারে। শরীর-মন চমকে দিয়ে হঠাৎ রাস্তা পেরোল গোটা তিনেক ময়ূর।
শিলিগুড়ির ডুয়ার্স। সমরেশ মজুমদারের কালবেলা বা সাতকাহনের ডুয়ার্স। গরুমারা, চাপরামারি, জলদাপাড়া, গজলডোবা, ঝালংয়ের মতো সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে হেথায়। দুয়ার মানে দরজা, সেই থেকে সাহেবরা নাম দিয়েছেন ডুয়ার্স। কলকাতা থেকে রাতের ট্রেনে চড়ে সকালে পৌঁছেছি নিউ জলপাইগুড়ি। এবার আমাদের ভ্রমণ তালিকায় আছে গরুমারা আর চাপরামারি। ট্রেন থেকে নেমে একটা জিপে করে সেবক ধরে চালসা হয়ে ডানে মোড় নিয়ে লাটাগুড়ির রাস্তায় ওঠলাম। গরুমারা বেশি দূরে নয় আর। ১৯৪৯ সাল থেকে এটি অভয়ারণ্য। আগে ছিল শিকার-প্রাণী সংরক্ষণকেন্দ্র।
সাকল্যে তিন ঘণ্টা লাগল তেমাথায় যেতে। মোড়ে বাইসনের এক বিশাল ভাস্কর্য। গরুমারা জঙ্গল ক্যাম্পের মুখে পৌঁছে গেছি। অরণ্য নামের এক রিসোর্টে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মালপত্র ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়লাম। ডুয়ার্সের পশ্চিমে তিস্তা, পুবে আসাম, উত্তরে ভুটান আর দক্ষিণে কোচবিহার।
বড় রাস্তার দুই পাশেই জঙ্গল। বাস চলছে মাঝেমধ্যে। একটা বাজারে ছানা, জিলাপি আর চা খেলাম। তারপর সোজা গেলাম ওয়াচ টাওয়ার। নয়ন জুড়িয়ে গেল। সামনে শুধু সবুজের সমুদ্র। জঙ্গলের পেছনেই নেওড়া নদী শব্দ তুলে অবস্থান জানান দিচ্ছে। নিচেই অনতিদূরে একটা বড় জলাশয়। গাইড বলল, এখানে হাতি গোসল সারে। ভোরে এলে নাকি হাতিস্নান চাক্ষুষ করা যায়!
ওয়াচ টাওয়ার থেকে নিচে নেমেই একদল ময়ূরের দেখা পেয়ে গেলাম। নল-খাগড়ার ঝোপের ভেতর প্রথম একটা নীলকণ্ঠ ঘাড় উঁচু করে তাকাল। তারপর দুটি, তারপর তিনটি, তারপর গোটা দল। ক্যামেরা চোখে তুলতেও ভুলে গেলাম। কিছুক্ষণ মোটে, তার পরই ময়ূরগুলো উড়াল দিল। সবুজের পশ্চাৎপটে গাঢ় নীলের জাদুকরী উড়াল! গিয়ে বসল শিমুল গাছের ডালে।
বিকেল গড়িয়ে গেল। নেওড়া নদীর ওপরে বিশাল ব্রিজ। ওপারে বসতি। ব্রিজের কাছে ছোট বাজার। বটগাছ। আশপাশটা ঘুরে দেখলাম। ছিমছাম পরিচ্ছন্ন ঘরবাড়ি। সুস্বাদু তালের শাঁস, তাজা ডাবের পানি, পাকা পেঁপে খেলাম। তারপর নদীর ধারে বসে রইলাম। স্রোতের চঞ্চল স্বাচ্ছন্দ্যে বয়ে চলা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। পানি বদলে হয়ে গেল সোনা। তারপর ঝুপ করে দিগন্ত, আকাশ, চরাচর অন্ধকার হয়ে গেল।
ফিরে এলাম রিসোর্টে। ৭টায় খাবার দেওয়া হলো। আলুর চপ, মুরগির ভুনা মাংস, ডাল আর মিক্সড ভেজিটেবল। শেষে এক বাটি দই। ফিরে এসে রুমের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছি। সব চুপচাপ। কান খাড়া করে বসে আছি। নৈঃশব্দ ভেতরে ঝিম ধরিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ কোনো নাম না-জানা পাখি ডেকে উঠল। শিহরিত হলাম।
পরদিন খুব ভোরে আবার ওয়াচ টাওয়ার। এবার আর মিস হলো না। গোটা দশেক হাতির একটা ছোট্ট দল দেখলাম। সঙ্গে দুটি শাবক। এরপর জিপ সাফারিতে যোগ দিলাম। দুই ঘণ্টা অরণ্যের গহিনে ঘুরলাম। সেগুন, শাল, চিলৌনি, বহেড়া, জিওর, ওদাল, লালি-নানা রকম গাছ দেখলাম। নদীর ধারে বেশি শিমুল, শিরীষ আর খয়ের গাছ। পাখি খুব একটা দেখলাম না। সাফারি শেষ করে গেলাম নেওড়া জঙ্গল ক্যাম্পে। আজকের রাতটা এখানেই। ক্যাম্পটি বন বিভাগের নিজস্ব। গভীর জঙ্গলের মধ্যে এই ক্যাম্প। দ্রুত রাত নামল। ডিনার সারতে ডাইনিং রুমে গেলাম। দেয়ালে পাখি, বন্য প্রাণী, পতঙ্গ আর সাপের ছবি। এগুলো এই গরুমারায় দেখা যায়। ডিনার সেরে রুমের বারান্দায় গিয়ে বসি। সব চুপচাপ হয়ে যেতেই অরণ্যের গহিন থেকে ভেসে এলো বন্য প্রাণীর ডাক। দারুণ নিঝুম রাত গভীর হতে চায় না। তবে ঘুম চলে এলো। পরদিন সকালে জলদাপড়া আর গজলডোবা হয়ে এগিয়ে যাই জলপাইগুড়ি। ডুয়ার্স ভ্রমণ এখানেই সমাপ্ত।
কিভাবে যাবেন
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে এসআর, শ্যামলীসহ আরো কিছু পরিবহনের বাসে বুড়িমারী যাওয়া যায়। ভাড়া ৭০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। ওপার থেকে টাটাসুমোয় লাটাগুড়ি পৌঁছতে লাগে তিন ঘণ্টা। ভাড়া তিন হাজার টাকা। শেয়ারের জিপে জনপ্রতি ভাড়া ৩৫০ টাকা। এক রাত লাটাগুড়ি তো আরেক রাত চাপরামারিতে থাকতে পারেন। লাটাগুড়ির গরুমারা জঙ্গল ক্যাম্পে থাকতে ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারের (জলপাইগুড়ি) সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। বন বিভাগের আবাসে ভাড়া এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া অনেক হোটেলও আছে। আটজনের একটি ভ্রমণদলের দুই দিনে জনপ্রতি খরচ হতে পারে ১০ হাজার টাকা। সব ধরনের তথ্য ও সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ : বিয়ন্ড অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড ট্যুরিজম : ০১৯১৪০৯৯৭০০।
-কালের কণ্ঠ অবলম্বনে