বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে ভারত যে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে করতে চাইছে – সেই কালাদান ও ত্রিদেশীয় হাইওয়ে নিয়ে তারা নতুন উদ্যোগে তৎপরতা শুরু করেছে।
আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের বৈঠকে যোগ দিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এখন মিয়ানমারে, সেখানে জোট স্তরে ও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক স্তরে এই দুটি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে ভারত নিশ্চিত করেছে।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, বাংলাদেশে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে ও বিকল্প সংযোগ-পথ খোলা রাখার তাগিদেই ভারতের জন্য এই প্রকল্পগুলো অত্যন্ত জরুরি।
কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প ও ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় হাইওয়ে – এই দুটি প্রকল্পেরই অবতারণা হয়েছিল এমন একটা সময়ে যখন দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্ক ছিল একেবারে তলানিতে, বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ভারতের ট্রানজিট পাওয়াও মনে হচ্ছিল একরকম অসম্ভব।
কিন্তু ২০০৯ সালের গোড়ায় শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সেই পরিস্থিতিতে নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে, আর নানা কারণে মন্থর হয়ে পড়েছে কালাদান ও ত্রিদেশীয় হাইওয়ে প্রকল্পের কাজও।
কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের চলতি মিয়ানমান সফরেই যে এই প্রকল্পগুলোতে আবার গতি আনার চেষ্টা হবে, ভারত তা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিনের কথায়, ”আমরা মিয়ানমারকে ভারত ও আসিয়ানের মধ্যে একটা সেতু হিসেবে দেখি। ফলে এখানে কানেক্টিভিটি বা সংযোগ-সংক্রান্ত অনেকগুলো বিষয় থাকবে।”
”তারই অংশ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ত্রিদেশীয় হাইওয়ে প্রকল্প ও কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের বাস্তবায়ন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করবেন।”
কালাদান প্রকল্পের বিশেষত্ব হল কলকাতা থেকে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দর হয়ে তারপর কালাদান নদীপথে এবং শেষে সড়কপথে পণ্য পাঠানো যাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে।
আর ত্রিদেশীয় হাইওয়ের নকশা আঁকা হয়েছে মণিপুরের মোরে থেকে থাইল্যান্ডের মা-সত পর্যন্ত, মাঝপথে তা মিয়ানমারে মান্দালে ও রেঙ্গুনকে ছুঁয়ে যাবে।
২০১৬র মধ্যে এই হাইওয়ে চালু করতে চায় সংশ্লিষ্ট তিনটি দেশ, আর কালাদান প্রকল্পর উদ্বোধন শুধু সময়ের অপেক্ষা, বলছিলেন দিল্লিতে আসিয়ান-ইন্ডিয়া সেন্টারের কোঅর্ডিনেটর ও কানেক্টিভিটি বিশেষজ্ঞ ড: প্রবীর দে।
তিনি জানাচ্ছেন, সিতওয়ে-তে সম্পূর্ণ নতুন বন্দর তৈরি করে দিচ্ছে ভারত, যেটা যে কোনও সময়ই চালু হয়ে যেতে পারে। তবে কালাদান নদীর উজানে অভ্যন্তরীণ নদী-বন্দর ও মিয়ানমারের কিছু সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা তৈরির কাজ এখনও বাকি।
তবে যেহেতু মিয়ানমারের ওই রাখাইন প্রদেশে তেমন কোনও শিল্প নেই এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও কতটা পণ্য আসবে-যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে – তাই সিতওয়ে-তে একটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।
এই বিশাল কর্মকান্ড থেকে বাংলাদেশকে সম্ভবত সচেতনভাবেই বাইরে রাখা হয়েছিল, সেখানকার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ট্রানজিটের প্রশ্নে সংবেদনশীলতার কারণেই।
তবে থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ – দুটো দেশেই ভারতের রাষ্ট্রদূতের পালন করেছেন যিনি, সেই সাবেক কূটনীতিক পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী একে ঠিক বাংলাদেশকে পাশ কাটানো বলতে রাজি নন।
তাঁর বক্তব্য হল, বিকল্প পথ খোলা রাখাটা সব সময়ই জরুরি বা ”স্ট্র্যাটেজিক রিকোয়ারমেন্ট” যাতে একটা পথ বন্ধ হলেও অন্যটা ব্যবহার করা যায়।
মি. চক্রবর্তী আরও বলছেন, ”বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ভারতের পণ্য তো যাচ্ছেই। এরপর চট্টগ্রাম বন্দরও যদি ভারত ব্যবহারের সুযোগ পায়, তাহলে কালাদান ও চট্টগ্রাম হবে একে অন্যের পরিপূরক। চট্রগ্রাম থেকে সুবিধা পাবে কাছের রাজ্য ত্রিপুরা, আর কালাদানের মাধ্যমে উপকৃত হবে মিজোরাম. মণিপুর বা নাগাল্যান্ড।”
তবে ঘটনা হল, ট্রানজিটের প্রশ্নে ইদানীং অনেক ছাড় পাওয়ার পরও দীর্ঘমেয়াদে ভারত তাদের উত্তরপূর্বাঞ্চল ও আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগের জন্য বাংলাদেশের ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছে না।
পাশাপাশি, এই অঞ্চলে যে বিপুল পণ্য পরিবহনের সম্ভাবনা আছে তা সামলানোর মতো অবকাঠামোও বাংলাদেশে নেই, মনে করেন প্রবীর দে। তাঁর মতে, ভারতের পণ্যবাহী ভারী ভারী ট্রাক বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে চলাচল করলে সেখানকার রাস্তার ক্ষতি হবে, এমন কী অনেক নদীর ওপর ব্রিজও ভেঙে পড়তে পারে।
তাঁর কথায়, ”সে কারণেই বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যে যুক্তি আছে – ট্রানজিট পেতে হলে অবকাঠামো ভারতেকেই তৈরি করে দিতে হবে। ব্রিজ, রাস্তা, বিদ্যুৎ সংযোগ এগুলোর দায়িত্ব তখন ভারতকেই নিতে হবে।”
এই সব কারণেই দিল্লি হঠাৎ করে জোরালো তৎপরতা শুরু করেছে কালাদান আর ত্রিদেশীয় হাইওয়ে নিয়ে – যে প্রকল্পদুটো শেষ হলে ট্রানজিটের জন্য তাদের আর শুধু বাংলাদেশের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না বলে ভারতের আশা।
-বিবিসি বাংলা অবলম্বনে