মাসিদ রণ: সফল নারী উদ্যোক্তাদের একজন জিনিয়া আফরোজ। জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউজ মানজ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ডিজাইনার। মানজ ফ্যাশন হাউসটি মাত্র সাড়ে তিন বছরে ফ্যাশনেবল নারীদের আস্থাভাজন ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে।
জিনিয়া আফরোজ ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়েই পড়াশুনা করেছেন। ডিপ্লোমা কোর্স করেছেন রেডিয়েন্ট স্কুল অব ডিজাইন থেকে। পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছেন শান্ত মারিয়াম বিশ^বিদ্যালয় থেকে। কিন্তু তার পরিবারই চায়নি মেয়ে ডিজাইনার হোক। তার পরিবারের সবাই সরকারি চাকুরিজীবী। বড় বড় পোস্টে আছেন, তাই বাবা-মা চেয়েছেন তার মেয়েও নিশ্চিত জীবনের জন্য সরকারি চাকুরি করুক। কিন্তু জিনিয়া ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশনেবল পোশাকের প্রতি আগ্রহ ছিল তার। নিজেই চেষ্টা করতেন দর্জিকে দিয়ে নতুন ডিজাইনের পোশাক বানাতে। স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তার ডিজাইন করা পোশাক অনেক মানুষ পরবে, সবাই প্রশংসা করবে। আজ তাই হয়েছে। কিন্তু একজন নারী হিসাবে অনেক বাঁধা আর পরিশ্রম করতে হয়েছে আজকের অবস্থানে আসতে গিয়ে।
এজন্য তিনি সরকারের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ। জিনিয়া বলেন, ‘প্রথমেই আমি ইপিবি (এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো) থেকে সিলেক্ট হই। সাধারনত অনেক দিনের অভিজ্ঞতা ছাড়া তারা কারও প্রপোজাল একসেপ্ট করে না। কিন্তু আমার পড়াশুনার রেজাল্ট ভালো হওয়ার কারনে সুযোগ পাই। ইপিবির ফেয়ারগুলোতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি থাকেন। মূলত বাংলাদেশের ফ্যাশন পণ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার একটা প্ল্যাটফর্ম এটি। সরকারি এই সুযোগ পেয়ে আমি খুবই আপ্লুত ছিলাম। সেই ফেয়ার থেকেই আমার বিদেশি অনেক বায়ারের সঙ্গে পরিচয়। যাই হোক, বিদেশে ফেয়ারে গিয়ে দেখি আমরা যে দোকান মাত্র ৫০-৬০ হাজার টাকায় পেয়েছি, অন্য দেশের লোকরা কয়েক লাখ টাকা দিয়ে সেই দোকন নিয়েছে। তখন বুঝতে পারি সরকার আমাদের এসব জায়গায় কতোটা সুযোগ দিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বার বার সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কারণ আছে। মানজ-এর বাইরে আমার আর একটি শোরুম আছে। সেটি সরকারের কাছ থেকে পেয়েছি। শুধুমাত্র সার্ভিস চার্জ ছাড়া সেখানে আর কোন খরচ নেই। নারীদের সাবলম্বী করার জন্য এটা একটা প্রজেক্ট। এখানে অসহার নারীদের কাজ করার সুযোগ তৈরী হয়েছে।’
জিনিয়া আফরোজ কাজ শুরু করেন বিখ্যাত দশটি দেশি ব্রান্ড মিলে গঠিত ‘দেশি দশ’-এর একটি ব্রান্ডের ডিজাইনার সেকশনের ইনচার্জ হিসাবে চাকরি করেছেন।নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশি দশে শর্ত ছিল নিজের কোন প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে না। স্বপ্ন পূরণের জন্য সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে মানজ প্রতিষ্ঠা করি। এখন এই ফ্যাশন হাউজ সফলতার সঙ্গে চলছে, পাশাপাশি একটি ইন্টারন্যাশনাল এনজিওতে চাকরিও করছি। এখানে কোন শর্ত নেই। নিজের মতো কাজ করতে পারছি।’
সফলতা পেছনের রহস্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে কাজটাকে ভালোবাসা আর কাজের প্রতি দক্ষতা জরুরী। আমি যখন দেশি দশে চাকরি করতাম, তখন দেখি সেখানেও ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়াশুনা করা লোক খুব কম। এখনো যারা ঘরে ঘরে বুটিক করেছে, তারা কিন্তু তেমন কিছু না জেনেই কাজ করছে। কিন্তু আমি চাকরি করে যেমন হাতে কলমে শিক্ষা পেয়েছি, তেমনি থিওরিগত বিষয়ও জানি। কিভাবে প্যাটার্ন কাটে, কোন রঙের সঙ্গে কোন রঙ মিশাতে কি রং হয়, রঙ কিভাবে পাকা হয়, ফ্রেব্রিকের মান কেমন, সবই আমাদের জানতে হয় ডিগ্রি নিতে গেলে। কিন্তু অনেকেই তো ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ে। সফল হয় কয় জন? সবার দক্ষতা একইরকম হয় না। আমি কাজটা বুঝে করছি বলেই হয়ত সমস্যা হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো ভালো মানুষ হওয়া। আমি কখনো কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহান করি না। কারও ক্ষতি চাই না। মানুষ ঠকাতে চাই না। অল্প লাভে ভালো পন্য সরবারহ করি।তাই হয়ত ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি।’
মানজ নিয়ে জিনিয়া বলেন, ‘আমি এখানে শুধু দেশি পোশাক রাখি না। কারন সবার পছন্দ এক রকম নয়। কেউ ভারতীয় আ পাকিস্তানি পোশাক খুব পছন্দ করে। তাই কম দাম থেকে শুরু করে বেশি দামের দেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি পোশাক এখানে পাওয়া যায়।’
করোনাকালে যখন অনেক ব্র্যান্ড বেচাকেনায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি, তখন মানজ অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বেশ ভালো করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে এই ব্র্যান্ডের স্বত্তাধিকারী বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা জিনিয়া আফরোজের দুরদর্শিতার জন্য। তিনি নিয়মিত মানজের পোশাক ফেইসবুক লাইভের মাধ্যমে ক্রেতাদের চোখের সামনে নিয়ে আসেন। এতোদিন নিজেরাই কাজটি করলেও মানজ এবার আরও বড় পরিসরে লাইভ নিয় হাজির হচ্ছে। মানজের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন চট্টগ্রামের জনিপ্রয় মেকাপ আর্টিস্ট ও ব্লগার নওশীন চৌধুরী। এখন থেকে নওশীন মানজের পোশাক নিয় ফেইসবুক লাইভ করবেন। এ প্রসঙ্গে জিনিয়া আফরোজ বলেন, ‘প্রথমে আমি লাইভ করতাম। আমার ছোট বোন নাটকে অভিনয় করে। তাকে দিয়েও জোর করে কিছু লাইভ করিয়েছি। কিন্তু কথায় আছে না, যার কাজ তাকেই মানায়। আমি যে কোন কাজ করতে গেলেই বড় পরিসরে করি, নয়ত একদম করিই না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম দেশের বেস্ট ব্লগারকে দিয়েই আমার পোশাকের লাইভ করাব। আমাদের পোশাক নিয়ে মাসে মোট ৬টি লাইভ করছেন নওশীন। প্রতি শুক্রবার তিনি আমাদের পোশাকগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরবেন ক্রেতাদের সামনে। বাকী দুটি লাইভে তিনি একদিন প্রশ্ন-উত্তর দেবেন, অন্যদিন মানজের এক্সক্লুসিভ ব্রাইডাল পোশাকগুলো দেখাবেন। আশা করছি আমাদের ট্রেন্ডি পোশাকগুলো সবার মন জয় করবে।’
উল্লেখ্য মানজ-এর পোশাক বিভিন্ন ফ্যাশন শো, দেশি-বিদেশি ফ্যাশন ফেয়ার ও বিউটি কনটেস্টে ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি ‘মিস্টার এন্ড মিস ফটোজেনিক’ প্রতিযোগীতার কস্টিউম পার্টনার ছিল মানজ।
You must be logged in to post a comment.