নিজ ভূমিতেই উদ্বাস্তু হওয়ার করুন ইতিহাস ফিলিস্তিনিদের। যাদের আশ্রয় দিয়েছিল নিজ মাতৃভূমিতে, সেই ইহুদিরাই আজ মাথা গোঁজার ঠাই কেড়ে নিয়ে শরণার্থী বানিয়েছে লাখো মানুষকে। আবার হারানো ভূমি ফিরে পাওয়ার আন্দোলনে নেমে সন্ত্রাসী তকমা পেয়েছে অভাগা ফিলিস্তিনিরা। তবুও একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ও ফিলিস্তিনের ইতিহাস জানাবো আজ।
অটোমান সম্রাজ্যে শান্তির ফিলিস্তিন ভূখণ্ড:
১৯ শতকের গোড়ার দিকের কথা। একদিকে কৃষি কাজ, অন্যদিকে সমুদ্রে মাছ শিকার। অটোমান সম্রাজ্যে নিজ ভূখণ্ডে শান্তির বাস ফিলিস্তিনিবাসীর।
ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ও ফিলিস্তিনের ইতিহাস:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পতন হয় অটোমানের। সম্রাজ্যের একের ভূখন্ড চলে যায় একেটির দেশের হাতে। উপনিবেশে পরিণত হয় ফিলিস্তিন। নতুন শাষক ব্রিটিশদের অধীনে তখন থেকেই সূচনা হয় ফিলিস্তিনিদের পরাধীনতার শৃঙ্খল।
ইহুদিদের আশ্রয়দান:
বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু অবস্থায় থাকা ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি স্থায়ী আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা শুরু করে যুক্তরাজ্য। ১৯১৭ সালে ঘোষণা করা হয় বালফোর ডিক্লেয়ারেশন। ঠিক তখনই গোড়াপত্তন হয় ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের।
ব্রিটেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বল্প পরিসরে ইহুদিরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে শুরু করে। বিত্তশালী ফিলিস্তিনিরা তাদের নানাভাবে সাহায্য করে। চাষাবাদের জন্য ছেড়ে দেয় কৃষি জমি। অনেক মধ্যবিত্ত ফিলিস্তিনি আবার বিক্রি করে তাদের জমি।
ঠিক এর কয়েক বছর পরই ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন হিটলরা। জার্মানিসহ পুরো ইউরোপ থেকে দলে দলে পালিয়ে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে পাড়ি জমায় লাখো ইহুদি। বসবাস করতে শুরু করে ফিলিস্তিনজুড়ে। এরপর আরো জোড়ালো হয় একটি ইহুদিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।
ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন:
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সদ্য গঠিত জাতিসংঘে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রস্তাব দেয় যুক্তরাজ্য। প্রস্তাব গ্রহণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনিদের ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ আর সংখ্যায় অল্প থাকা ইহুদিদের ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভূমি দিয়ে দুই রাষ্ট্র গঠন করে জাতিসংঘ। আর মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেমকে রাখা হয় আন্তর্জাতিক ভূমি হিসেবে।
ইহুদিরা জাতিসংহের প্রস্তাব মেনে নেয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ই মে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইহুদি নেতারা। নিজ ভূখণ্ড থেকে উদ্বাস্তু হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনি। ওই দিনটিই আল নাকবা নামে পরিচিতি পায় বিশ্বব্যাপী।
প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ:
এরপরই ইসরাইলে বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধে জড়ায় আরব দেশগুলো। প্রাথামিক অবস্থায় ভালো অবস্থায় থাকলেও, নেতাদের সমন্বয়হীনতা আর নেতৃত্বের অভাবে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয় আরব দেশগুলো। ফিলিস্তিনের ৭৮ ভাগ ভূমি দখল করে নেয় ইসরাইল।
ছয় দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ:
১৯৬৭ সালে আবারো আরবদের সাথে যুদ্ধ হয় ইসরাইলের। ৬ দিনের ওই যুদ্ধে পুরো ফিলিস্তিনিই দখল করে ইসরাইল। পরে একটি চুক্তির আওয়ায় ফিলিস্তিনিদের কিছু জমি ছেড়ে দেয় দখলদার বাহিনী। ইসরাইলের এমন নির্বিচারে এক সময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় ফিলিস্তিনিদের। ১৯৮৭ সালে গঠন করা হয় স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস।
১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইল স্বাক্ষর করে অসলো চুক্তি। কিন্তু ভূখণ্ডের পানি এবং সম্পদে পূর্ণ এলাকাগুলোর দখল ধরে রাখে দখলদাররা।
এরপর থেকেই ফিলিস্তিনিদের ওপর একের পর এক হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। ২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে বিমান এবং স্থল হামলার মাধ্যমে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। নিশ্চুপ থাকে বিশ্ব সম্প্রদায়।
অসহায়ত্বের দোহাই দিয়ে আশ্রয় নেওয়া ইহুদিরাই আজ গ্রাস করছে ফিলিস্তিনিদের। হত্যা, অত্যাচার আর নিপীড়নের মাধ্যমে গাজা উপত্যকাকে পরিণত করেছে একটি শিকবিহীন কারাগারে, যেখানে স্বাভাবিক মৃত্যু এখন অস্বাভাবিক। তবুও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রক্তিম সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় অসহায় লাখো ফিলিস্তিনি।