মেয়েটির মিষ্টি কণ্ঠ। মায়ের খুব শখ ছিল মেয়ে গানের মানুষ হবে। কিন্তু চঞ্চল মেয়েটির গানের তালিমে কি মন বসে? গানের শিক্ষক তাই প্রায় দিনই তাকে আবিষ্কার করতেন খাটের তলায়। মা বুঝে ফেললেন, মেয়েকে দিয়ে গান হবে না। তার পছন্দমতো শিশু একাডেমিতে শুরু হলো নাচের চর্চা। নেচে পুরস্কারও পেয়েছে অনেক।
গল্পটা ছোটপর্দার প্রিয়মুখ অ্যানি খানের। মডেল হিসেবে পথচলা নব্বইয়ের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে। তখন সবে ক্লাস টুতে। নাচ দেখেই পরিচালক তাকে পছন্দ করেন। সেটি ছিল ফু ওয়াং ফুডের বিজ্ঞাপন। এরপর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় করলেন কোকোলার টিভিসি। মা ভেবেছিলেন, এখানেই ক্ষান্ত। কিন্তু অ্যানি নিজেকে এই অঙ্গনেই দেখতে চেয়েছেন। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ২০০৪ সালে তারিক আনাম খানের নির্দেশনায় ‘হুইলে’র টিভিসিতে এলেন পুরোদস্তুর গৃহিণীর বেশে।
‘আমি দেখতে এখনো অনেকটা বাচ্চাদের মতো। আর তখন তো বয়স আরো কম ছিল। পাক্কা গৃহিণী হিসেবে আমাকে কেমন মানাবে তা নিয়ে চিন্তায় ছিল সবাই। তবে আমার মনে হয়েছিল, আমি পারব। বেশ কদিন কাপড় ধোয়ার প্র্যাকটিস করেছি বাসায়। মাকেও ফলো করেছি। আর মেকআপ আর্টিস্ট আমাকে এমন করে সাজিয়ে দিলেন, আমি নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। তারিক আনাম খানও বললেন, আরে, এ যে সত্যিই পাক্কা গৃহিণী।’ তবে ঝক্কি কিছুটা পোহাতেই হয়েছে। অ্যানি বলতে লাগলেন, ‘সবাই আমার চেহারা নিয়ে ভয়ে ছিলেন, সেখানে ভালোমতোই উৎরে যাই। কিন্তু গোল বাধল অন্যখানে। ১০ কদম হাঁটতে হবে, কিন্তু এ কাজটিই আমি ২০ টেকেও ওকে করতে পারছিলাম না। যতবার হাঁটছি, মনে হচ্ছিল আমি বাঁকা হয়ে যাচ্ছি। কারণ আমার অতিরিক্ত সিরিয়াসনেস। পরে তারিক আনাম স্যার আমাকে এমনভাবে ক্যামেরার ভাষা বোঝালেন যে আর কোনো দিন কোনো টিভিসিতে এ ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়নি।’
২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭০টির মতো টিভিসি করেছেন অ্যানি খান। তাঁর মধ্যে ৪৫টির মতো টিভিসির নাম বলে গেলেন একনাগাড়ে। তারপর আর মনে করতে পারলেন না। এত বছর আগের এতগুলো কাজ মনে রাখা কি সম্ভব?
প্রথম থেকেই জিঙ্গেলনির্ভর কাজ এড়িয়ে গেছেন, কাজ করেছেন গল্পপ্রধান টিভিসিতে। তাঁর প্রতিটি টিভিসির গল্প, নির্মাণ আর চরিত্র আলাদা আলাদা।
‘এখানে নিজের কোনো কৃতিত্ব নেই। আসলে আমার চেহারাটাই এমন যে মেকআপ ছাড়া আর মেকআপসহ আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বাস্তবে আমাকে অনেক বাচ্চা লাগলেও মেকআপ দিয়ে পর্দায় যেকোনো চরিত্রে উপস্থাপন সম্ভব।’ বললেন অ্যানি।
আরেকটি জিনিসের জন্যও সৃষ্টিকর্তাকে বিশেষ ধন্যবাদ দেন অ্যানি। তা হলো তাঁর কণ্ঠ। ‘আমি প্রথম প্রথম কাজ শুরু করলে সবাই বলত, তোমার কণ্ঠটা এত বাচ্চা যে তরুণী চরিত্রে যায় না। সবার কথা শুনতে শুনতে আমারও মনে হতো, ইস! কণ্ঠটা যদি পাল্টাতে পারতাম। কিন্তু এখন আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে। কারণ অনেক দর্শক আমাকে মেকআপ ছাড়া চিনতে না পারলেও ঠিকই কণ্ঠ শুনে বলেছেন-আপনি অ্যানি না? তাই আমি চাইব যত দিন বেঁচে আছি আমার কণ্ঠ যেন এমন চিরসবুজই থাকে, হা হা হা…’ জানালেন অ্যানি।
নিজের এত এত টিভিসির মধ্যে নিজেরই পছন্দ এমন বেশ কিছু কাজ আছে। এর মধ্যে রয়েছে গোলাম হায়দার কিচলুর বানানো ম্যাজিক টুথ পাউডারের টিভিসি। এখানে পিংকি থাকেন অ্যানি। সিএনজিচালক মফিজের গার্লফ্রেন্ড। আবার তারিক আনাম খানের পিএইচপি টিনের বিজ্ঞাপনে আবুল হায়াতের মেয়ে অ্যানি স্বামী চঞ্চল চৌধুরীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বাবা আমি যামু না, তোমার জামাই শুধু সস্তা খোঁজে।’ আদ্যোপান্ত শহুরে অ্যানির এমন গ্রামীণ নারী হয়ে ওঠার দক্ষতা দর্শককে মুগ্ধ করে।
তিনি গ্লামারাস চরিত্র নিয়েও হাজির হয়েছেন তিব্বত পাউডার, হেনলাক্স ক্রিম, ওয়ালটন মোবাইল ও ফ্রিজ, ইলেক্ট্রা ফ্রিজ, হাইকন টিভির মতো পণ্যের টিভিসিতে। এর মধ্যে তিব্বতের টিভিসিটি অ্যানির বেশ মনে ধরেছে। এর শুটিং হয়েছিল কলকাতায়।
এ ছাড়া উল্লেখ করলেন পেপসোডেন্টের টিভিসির কথা, শুটিং হয়েছিল থাইল্যান্ডে। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন, একমাত্র তিনি ছাড়া ইউনিটের সবাই অস্ট্রেলিয়ান। আন্তর্জাতিক মানের এই টিভিসি তখন বাংলাদেশ ছাড়া ভারত ও শ্রীলঙ্কায় প্রচার হতো।
অর্জন আরো আছে এই মডেলের। তিনিই বোধ হয় একমাত্র মডেল, যিনি একাধারে দেশের শীর্ষস্থানীয় তিনটি টেলিকম ব্র্যান্ড গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবির টিভিসি করেছেন। কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মতো নির্দেশকের সঙ্গে। বর্তমানে চলছে মিল্লাত নিম টুথ পাউডার ও বেঙ্গল ফোমের টিভিসি দুটি। সামনে আরো কিছু আসছে, যেগুলোতে তাঁকে দর্শক দেখবে নতুনরূপে।
You must be logged in to post a comment.